বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি–জামায়াত জোট একসময় ছিল একটি অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও ক্ষমতার রাজনীতিতে তারা কখনোই উপেক্ষিত ছিল না। কিন্তু সময়ের বাস্তবতা বদলেছে। আজ এই জোটের রাজনীতি ভেঙে পড়েছে আস্থা, নেতৃত্ব ও আদর্শের সংকটে। ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা, পারস্পরিক সন্দেহ আর ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি তাদের দিকহারা করে তুলেছে।
বিএনপির ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্ব সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিদেশে অবস্থানরত তারেক রহমান কার্যত দলের হাল ধরতে পারছেন না, আর দেশে সংগঠনের ভেতরে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আস্থাহীনতা বিএনপিকে অচল করে তুলেছে। মাঠে নেই আন্দোলন, কর্মীরা দিশাহীন, আর রাজনৈতিক অবস্থান অস্পষ্ট। ফলে দলটি এখন প্রতিক্রিয়াশীলতার ফাঁদে আটকে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও দেখা যাচ্ছে পুরনো অসুখ দলীয় প্রভাব, চাঁদাবাজি ও তদবীরবাজির রাজনীতি। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে বিএনপির ভেতরে। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের তিন নেতা মির্জা আব্বাস, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও তদবিরবাজির একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও প্রশাসনিক সূত্রগুলোর দাবি এই নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন খাতে অর্থ বাণিজ্য, কমিশন আদায় ও নিয়োগ তদবীরে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।
সূত্র জানায়, মির্জা আব্বাস, যিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন, তিনি রাজধানী ও কক্সবাজার অঞ্চলে নগর ভবন, গণপূর্ত, রাজউক ও ব্যাংক পাড়া পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ও তার অনুসারীরা জমি দখল, কলকারখানা দখল, উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য ও চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
চট্টগ্রামে খসরু–সালাহ উদ্দীনের কমিশন সাম্রাজ্য
অন্যদিকে, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে হোটেল, পর্যটন, ভূমি ও সামুদ্রিক ব্যবসা খাতে তদবীর ও কমিশন বাণিজ্যে সক্রিয় বলে জানা গেছে। এমনকি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, ব্যবসায়িক অনুমোদন ও লাইসেন্স প্রক্রিয়ায়ও তাদের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠেছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠতার পরিচয় ব্যবহার করে কিছু প্রভাবশালী নেতা এখন শুধু টাকা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। রাজনীতি নয়, এখন তাদের লক্ষ্য ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির ভেতরে আদর্শ নয়, বরং অর্থ ও ক্ষমতার লড়াই এখন প্রকট। মাঠপর্যায়ের নেতারা উপেক্ষিত, আর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা রাজনীতির আড়ালে চাঁদাবাজি ও তদবীরবাজিকে পেশায় পরিণত করেছেন। যে দল নিজেদের ‘গণতন্ত্র উদ্ধার মিশন’-এর নামে প্রচার করছে, সেই দলের নেতারা যদি জনগণের ঘামঝরা অর্থ লুটে ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, তবে তা কেবল দলের জন্য নয় দেশের রাজনীতির জন্যও অশনি সংকেত।
দেশের অর্থনীতি এমনিতেই টালমাটাল অবস্থায়, সেখানে রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দখলদারিত্ব যোগ হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে অনেকেই এখন ‘চাঁদাবাজ দল’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। রাজনীতির এই অবক্ষয় জনগণের মধ্যে বিরক্তি ও হতাশা সৃষ্টি করছে।
সম্প্রতি বরিশাল ২ আসনের বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু বলেন, গত ১ বছর ছোট খাটো চাঁদাবাজি আমরা ইচ্ছে করেই হইতে দিছি কারণ ১৭ বছর আমার নেতা-কর্মীরা কিছু খায় নাই। অর্থাৎ বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তারা চাঁদাবাজি আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থাও কম সংকটপূর্ণ নয়। দলটি রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে, সংগঠন কার্যক্রম সীমিত, এবং রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে তাদের প্রভাব প্রায় শূন্য। ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে তারা এখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাতেই বেশি ব্যস্ত। ফলে বিএনপি–জামায়াতের ঐতিহ্যগত জোট এখন কার্যত কাগজে-কলমের বন্ধন মাত্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই জোটে এখন ‘ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতি’ দৃশ্যমান। নেতৃত্ব নয়, বরং কে কতটা প্রভাব খাটাতে পারবে সেই প্রতিযোগিতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সংগঠনের অভ্যন্তরে গোষ্ঠীবাদ, ব্যক্তিস্বার্থ আর ক্ষমতার লোভ আন্দোলনের লক্ষ্য ও গণস্বার্থকে ছাপিয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, বিএনপি–জামায়াত ক্রমে গণভিত্তি হারাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনেও এই জোটের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। দলীয় প্রভাব ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার অভিযোগ বেড়েছে, যার ফলে জনগণের মধ্যে ভয় ও অনাস্থা দুটিই বাড়ছে। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোই এখন তাদের সবচেয়ে বড় সংকট।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল প্রয়োজন এ নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিতে শক্তি ফিরে পেতে হলে বিএনপি–জামায়াতকে আত্মসমালোচনা করতে হবে। কেবল সরকারের সমালোচনা নয়, নিজেদের ভেতরের দুর্বলতা, নেতৃত্বহীনতা ও বিভাজন কাটিয়ে উঠতে না পারলে তারা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারাবে নিশ্চিতভাবেই।
জনগনের আজ প্রশ্ন একটাই—বিএনপি–জামায়াত কি সত্যিই জনগণের দলে পরিণত হতে পারবে, নাকি ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতিতেই তাদের ভবিষ্যৎ ডুবে যাবে।