Share
বাংলাদেশের রাজনীতিতে “জুলাই আন্দোলন” এক বিভাজনময় অধ্যায়। রাজনৈতিক দাবি ও গণআন্দোলনের মুখোশে ঢাকা এই আন্দোলন পরিণত হয়েছিল সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ফেসবুক পোস্ট আবারও সেই অন্ধকার অধ্যায়ের পর্দা উন্মোচন করেছে।
‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে শফিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া দীর্ঘ পোস্টে স্বীকার করেছেন—তিনি জুলাই আন্দোলনের সময় বিএনপি ও জামায়াতের কাছ থেকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা পেয়েছিলেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, আন্দোলনের নামে সংঘটিত নাশকতার পেছনে ছিল একটি সংগঠিত নেটওয়ার্ক, যেখানে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির মানববল, পরিকল্পনা ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করেছিল।
শফিকুর রহমান তাঁর পোস্টে উল্লেখ করেন, রামপুরা টেলিভিশন ভবনে অগ্নিসংযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হামলা এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় কৌশলগত ধ্বংসযজ্ঞ ছিল “পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন।” তাঁর দাবি, তাঁকে একাধিকবার জামায়াত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে বৈঠকে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে “অর্থ বণ্টন ও সহিংস কৌশল” নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
অভিযোগ অনুযায়ী, আন্দোলনের নামে বস্তি ও নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে অর্থ বিতরণ করে তাদের মাঠে নামানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল গণআন্দোলনের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি করা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বর্তমানে সরকারের কিছু প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এতে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে—রাষ্ট্র কি আবারও রাজনৈতিক সমীকরণের কাছে ন্যায়বিচার বিসর্জন দিচ্ছে?
বিশ্লেষকদের মতে, শফিকুর রহমানের এই স্বীকারোক্তি বিএনপি–জামায়াত জোটের সহিংস রাজনীতির নতুন প্রমাণ হতে পারে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে বারবার দেখা গেছে—আন্দোলনের নামে আগুন, পেট্রোলবোমা, যানবাহন ধ্বংস এবং নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। অথচ প্রতিবারই দায় নির্ধারণ ও বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আংশিক বা স্থবির হয়ে পড়েছে।
সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, “একটি রাষ্ট্র যদি সহিংসতার দায় নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে ন্যায়বিচার কেবলই কাগুজে শব্দ। রাজনৈতিক অপরাধের দায়মুক্তি ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ বার্তা।”
এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—সহিংস রাজনীতি ও রাষ্ট্রের দায়হীনতা কি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে? আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের আড়ালে যদি অস্ত্র, অর্থ ও সংগঠিত সহিংসতা পরিচালিত হয়, তবে তা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত।
একই সঙ্গে বিশ্লেষকদের দাবি, আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা অর্থায়ন ও সমন্বয়কারীদের চিহ্নিত করতে হলে স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত কমিশন গঠন জরুরি। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এই স্বীকারোক্তি শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের পথে এগোলেও রাজনৈতিক সহিংসতা ও দায়হীনতা এখনো এক গভীর ঘা। জুলাইয়ের আগুনে যারা পুড়েছিল, তাদের স্মৃতি আজও জাতিকে প্রশ্ন করে—এই সহিংসতার বিচার কি কখনো হবে?
একটি সভ্য রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানে মতবিরোধ, কিন্তু তা কখনোই ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হতে পারে না। শফিকুর রহমানের স্বীকারোক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় দায়হীনতার সংস্কৃতি যতদিন চলবে, সহিংস রাজনীতি ততদিন বারবার ফিরে আসবে।
আরো পড়ুন