Friday, October 24, 2025

ইউনূস ম্যাজিকে অন্ধকারে উত্তরবঙ্গ, দেশ লুটেপুটে খাচ্ছে এনসিপি-বিএনপি-জামায়াত

Share

নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে দেশে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা। বিদ্যুৎ সংকট, ভারতের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের দাবি এবং আওয়ামী লীগের কার্যালয় দখলের ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে এমন অভিযোগ উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনার মাধ্যমে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে দেশকে দুর্বল করার চক্রান্ত চলছে।

দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় অবস্থিত কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট চরমে পৌঁছেছে। গত রবিবার (১৯ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৮টায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিট (১২৫ মেগাওয়াট) বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকালে ৩ নম্বর ইউনিট (২৭৫ মেগাওয়াট) গর্ভনর ভালভ স্টিম সেন্সরের ত্রুটিতে বন্ধ হয়। ২ নম্বর ইউনিট (১২৫ মেগাওয়াট) ২০২০ সাল থেকেই সংস্কারের জন্য বন্ধ রয়েছে। ফলে এই কেন্দ্র থেকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।

কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক নিশ্চিত করেছেন, পর্যাপ্ত কয়লা মজুত থাকলেও যান্ত্রিক সমস্যার কারণে উৎপাদন বন্ধ। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং ১ নম্বর ইউনিট এক সপ্তাহের মধ্যে চালু হতে পারে। কিন্তু ৩ নম্বর ইউনিটের সার্ভিসিংয়ে আরও সময় লাগবে। এই কেন্দ্রটি উত্তরবঙ্গের একমাত্র বড় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ইউনিট। এর বন্ধ হওয়ায় পার্বতীপুর উপজেলাসহ দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও থাকুরগাঁও—এই আট জেলায় লোডশেডিং এবং লো-ভোল্টেজের সমস্যা বেড়েছে। জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা হলেও চাহিদা মেটাতে পারছে না।

দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর পার্বতীপুর জোনাল কার্যালয়ের ডিজিএম জহুরুল হক বলেন, কেন্দ্র বন্ধ থাকায় তাদের জোনে দৈনিক চাহিদা ১৮ মেগাওয়াটের বেশি, কিন্তু সরবরাহ ঘাটতির কারণে ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র গরমে (৩২-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পল্লী এলাকায় গ্রাহকরা চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন। আমন ধানের সম্পূরক সেচ মৌসুমে কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, এই সংকট ‘ইউনূস ম্যাজিক’ নামে পরিচিত অন্তর্বর্তী সরকারের অদক্ষতার ফল।

এরই মধ্যে ভারতের আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি বাতিলের দাবিতে উঠেপড়ে লেগেছে আরেক চক্র। এর মূল চালিকাভূমিকায় রয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গত রোববার (১৯ অক্টোবর) তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে দাবি করা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে করা ১০টি চুক্তি ও প্রকল্প বাতিল হয়েছে। তালিকায় রয়েছে—টিপিএম পোর্ট, পায়রা বন্দর, রূপপুর পার্বতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল (মিরসরাই ও মোংলা)সহ আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি। বাকিগুলো বিবেচনাধীন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই দাবিকে অস্বীকার করেছেন। সোমবার (২০ অক্টোবর) রাতে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু ভারতীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানি জিআরএসই-এর সঙ্গে ট্যাগ বোট কেনার একটি চুক্তি বাতিল করেছে। আদানি চুক্তি সহ কয়েকটি পুনর্বিবেচনা বা বাতিলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তৌহিদ হোসেন বলেন, “যে তালিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে, তার অধিকাংশ চুক্তি বাস্তবে নেই। এটা সঠিক নয়।” তিনি আরও বলেন, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ আগামী বছর শেষ, এর নবায়ন নিয়ে আলোচনা চলছে। তিস্তা চুক্তি নিয়েও দীর্ঘদিনের কাজ চলছে, কিন্তু অগ্রগতি কম। ফেনী নদী চুক্তি এবং ২০২২ সালের সমঝোতা স্মারক বহাল রয়েছে।

আসিফ মাহমুদের পোস্টে উল্লিখিত তালিকাটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দাবির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা হচ্ছে। আদানি চুক্তি ২০১৭ সালে হয়েছে, যাতে বাংলাদেশ ১৬০০ মেগাওয়াট কেন্দ্র থেকে ২৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ আমদানি করবে। এটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ১০% পূরণ করে। বাতিল হলে আইনি জটিলতা এবং সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেবে। সরকারের প্যানেল চুক্তি যাচাই করছে, কিন্তু বাতিলের সম্ভাবনা কম।

এদিকে, রাজনৈতিক হিংসাত্মকতার আরেক দৃষ্টান্ত দেখা গেছে চট্টগ্রামে। এনসিপির চট্টগ্রাম নগর কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক আরিফ মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বে একদল তরুণ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) দুপুরে নিউমার্কেটের দোস্ত বিল্ডিংয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কার্যালয় দখল করে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের এই কার্যালয়ে প্রবেশ করে তারা জিনিসপত্র ভাঙচুর করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ধ্বংস করেছে। ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে ৪০-৫০ জন তরুণকে ভাঙচুর করতে দেখা যায়।

এনসিপির চট্টগ্রাম মহানগর সমন্বয়কারী রিদুয়ান হৃদয় বলেন, “নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ গোপনে এই কার্যালয়ে সভা করে ঝটিকা মিছিলের পরিকল্পনা নিচ্ছে। আমরা আলামত পেয়ে দখল করেছি।” কিন্তু কার্যালয়ের অফিস সহকারী আবদুল মালেক অভিযোগ করেন, ৫ আগস্টের পর কার্যালয় বন্ধ রয়েছে, কোনো নেতা আসেননি। তিনি বলেন, “তালা ভেঙে প্রবেশ করে ভাঙচুর করেছে তারা।” চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ঘটনা তদন্ত করছে।

পুরো দেশ জুড়ে এনসিপি-বিএনপি-জামায়াতের এমন দখলদারিত্ব চলছে। ভোলার চরফ্যাশনে এনসিপি আওয়ামী লীগের কার্যালয় দখল করে নিজেদের ব্যানার ঝুলিয়েছে। কুড়িগ্রামে বিএনপি ‘চর উন্নয়ন কমিটি’ গঠন করে আওয়ামী লীগের কার্যালয় দখল করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি নেতা আওয়ামী লীগের ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন’ কার্যালয়ে দোকান খুলেছে। এসব ঘটনা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে বলে সমালোচকরা বলছেন।

এই অস্থিরতার মধ্যে সেনাবাহিনীর নীরবতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম কার্যালয় দখলের ঘটনায় স্থানীয় সেনা ইউনিট সতর্ক করা সত্ত্বেও কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনী এই রাজনৈতিক হিংসায় নীরব থেকে পরোক্ষভাবে অস্থিরতা বাড়াতে সাহায্য করছে। সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ২০২৪ সালের জুলাই থেকে দেশজুড়ে মোতায়েন রয়েছে, কিন্তু এনসিপি-বিএনপি-জামায়াতের দখলদারিত্ব নিয়ে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

বিশ্লেষকর বলছেন, “বিদ্যুৎ সংকট এবং চুক্তি বাতিলের দাবি দিয়ে অশান্তি তৈরি করা হচ্ছে। এনসিপি-বিএনপি-জামায়াতের দখলদারিত্ব সরকারের প্রতি অসন্তোষ বাড়াচ্ছে। ইউনূস সরকারকে এসব থেকে মুক্তি দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

আরো পড়ুন

সদ্য প্রকাশিত