Share
নিজস্ব প্রতিবেদক
ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিচারগানের আসর বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাটা আসলে অনেক বড় একটা সত্যের দিকে আঙুল তুলে দেখায়। যে সরকার জুলাই মাসে রক্তের বন্যা বইয়ে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে, আর বিদেশি মদদে ক্ষমতায় এসেছে, তারা এখন বাংলার শেকড়ে কুঠারাঘাত করছে। ইউনুস আর তার প্রশাসনিক পুতুল ওয়াকার যে দেশটা চালাচ্ছেন, সেখানে এখন লোকসংস্কৃতির জন্যও জায়গা নেই।
বিচারগান মানে শুধু একটা গানের আসর না। এটা বাংলার মাটি থেকে জন্ম নেওয়া একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। শত শত বছর ধরে এই গান গাওয়া হয়েছে গ্রামে-গঞ্জে। মানুষ জড়ো হয়েছে, তর্ক করেছে, হেসেছে, গল্প শুনেছে। কিন্তু এখন দেড়শো লোক এসে বলছে এটা ইসলাম পরিপন্থী। আর প্রশাসন সেই কথা শুনে সব আয়োজন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। প্যান্ডেল খুলে ফেলছে। মানুষের স্বপ্ন, শ্রম, টাকা সব জলাঞ্জলি দিচ্ছে।
এই যে ইউএনও বলছেন দেড়শো লোক এসে চাপ দিয়েছে, তাদের ভয় দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলে। তো এই দেড়শো লোক কারা? কোন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি? যারা জুলাই মাসে পুলিশ হত্যা করেছে, সরকারি ভবন পুড়িয়েছে, রাস্তায় ককটেল ফাটিয়েছে, তাদেরই কি আরেকটা সংস্করণ এরা? আর যে প্রশাসন গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে বসেছে, তারা কেন এই গুটিকয়েক মৌলবাদীর কথায় নাচছে?
মজার ব্যাপার হলো, আয়োজক বলছেন উনি ইউএনও আর ওসি থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়েছিলেন। ইউএনও নিজেও বলছেন জেলা প্রশাসক অনুমতি দিয়েছিলেন। তার মানে কি? সব প্রস্তুতি শেষ, মানুষ জড়ো, দোকানদার তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে, আর তখন হঠাৎ করে কিছু লোক এসে ভয় দেখালো বলে পুরো আয়োজন বাতিল? এটা কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা? যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ইচ্ছেই শেষ কথা, আর বাকি সবাই পায় শুধু হতাশা আর লোকসান।
ইউনুস সাহেবের মাইক্রোক্রেডিটের ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকা আছে। বিদেশি দাতাদের পয়সায় ভরপুর তার সংস্থা। কিন্তু একজন স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বর যখন নিজের এলাকায় একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে চান, তখন সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ কী? কারণ কিছু মানুষ এসে বলেছে এটা তাদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে যায় না। অথচ এই একই দেশে শত শত বছর ধরে বিচারগান, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, কবিগান হয়ে এসেছে। তখন তো ইসলাম পরিপন্থী ছিল না।
সত্যি বলতে, যে সরকার গণতন্ত্রের খুঁটিই উপড়ে ফেলেছে, তাদের কাছে সংস্কৃতি বাঁচানোর আশা করাটা বোকামি হবে। যে সরকার সামরিক শক্তির জোরে টিকে আছে, সেই সরকার কখনোই জনগণের সংস্কৃতিকে সম্মান দেবে না। তাদের কাছে ক্ষমতা মানে শুধু ভয়ের শাসন। আর সেই ভয় তারা ছড়াচ্ছে প্রতিটা স্তরে। প্রশাসনের একজন ইউএনও পর্যন্ত এখন ভয়ে কাজ করছেন। জেলা প্রশাসকের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও কিছু লোকের চাপে তিনি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছেন।
ওয়াকার সাহেব সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। কিন্তু তার অধীনে যে প্রশাসন চলছে, সেখানে সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকারও নিরাপদ না। একটা গানের আসর করতে গিয়ে মানুষকে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। তাহলে এই সরকারের কাছে আর কী আশা করা যায়? তারা কি আসলেই দেশের মানুষের জন্য কাজ করছে, নাকি শুধু একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দাবি পূরণ করে যাচ্ছে?
বাংলাদেশ মানে বাঙালির দেশ। আর বাঙালি মানে তার সংস্কৃতি, তার গান, তার কবিতা, তার নাটক। এই জিনিসগুলো যদি মুছে ফেলা হয়, তাহলে থাকে কী? থাকে শুধু একটা ভূখণ্ড, যেখানে মানুষ বেঁচে আছে, কিন্তু তাদের প্রাণ নেই। ইউনুস আর ওয়াকার হয়তো ভাবছেন তারা শৃঙ্খলা আর নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করছেন। কিন্তু আসলে তারা যেটা করছেন সেটা হলো একটা জাতিকে তার পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা। আর যে জাতি তার নিজের পরিচয় হারায়, সে জাতি আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
নগরকান্দার সেই ওয়ার্ড মেম্বর সলেমান ফকির হয়তো ভেবেছিলেন কিছু দিনের জন্য মানুষকে একটু আনন্দ দেবেন। গ্রামের মানুষ এসে গান শুনবে, আড্ডা দেবে, কিছুটা সময় কাটাবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন চূর্ণ করে দিয়েছে একটা অবৈধ সরকার। যে সরকার নিজেই অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তারা এখন ন্যায়-অন্যায়ের বিচারক সেজেছে। এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?
আরো পড়ুন

