Share
বাংলাদেশ এখন পাক-মার্কিন গুপ্তচরে সয়লাব। কখন কি হয়ে যায় এমন আশঙ্কায় ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড় জনগণের। আর এই ‘কখন কি হয়’ এর একটা নমুনা আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি। এ বছর ৩১ অগাস্ট ঢাকার ওয়েস্টিন হোটেলের ৮০৮ নম্বর রুমে পড়ে ছিল একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তার মৃতদেহ। নাম টেরেন্স আরভেল জ্যাকসন। পরিচয় – মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ড (এয়ারবর্ন)-এর কমান্ড ইন্সপেক্টর জেনারেল। একজন গ্রিন বেরেটস অফিসার। যিনি ছয় মাস ধরে ঢাকায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে।
হোটেলে দু’দিন ধরে কোনো খাবার অর্ডার না দেওয়ায় কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তারা মার্কিন দূতাবাস আর পুলিশকে জানায়। দূতাবাসের মেডিক্যাল টিম আর পুলিশ মিলে ঘরে ঢুকে দেখে বিছানায় পড়ে আছে লাশ। এরপর যা হলো সেটা আরো অদ্ভুত। কোনো ময়নাতদন্ত ছাড়াই মৃতদেহ হস্তান্তর করা হলো মার্কিন দূতাবাসে। একজন বিদেশী নাগরিক মারা গেলে ময়নাতদন্ত করা বাংলাদেশের আইন। কিন্তু সেই আইন এখানে কাজ করলো না। কেন? কারণটা বুঝতে হলে আরেকটু গভীরে যেতে হবে।
মাত্র কয়েকদিন পর, ঢাকার আরেক পাঁচতারা হোটেল শেরাটনে আরেকটা লাশ। এবার পাকিস্তানি আইএসআই এজেন্ট। একই প্যাটার্ন। একই নীরবতা। কোনো তোলপাড় নেই, কোনো তদন্ত নেই। লাশ চুপচাপ চলে গেছে ইসলামাবাদ। দুটো ঘটনাই ঘটেছে প্রায় একই সময়ে। কাকতালীয়? নাকি পরিকল্পিত অপারেশন?
এর মধ্যেই সংবাদ মাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে শুরু হলো তুমুল আলোচনা। কোর থিয়োরি হলো- চীনের তিয়ানজিনে এসসিও সামিট চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপর হত্যা চেষ্টার পরিকল্পনা ছিল। সিআইএ বা তাদের সহযোগীরা এই কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি বিষয়টা আগেই টের পেয়ে যায় এবং তারা পুতিনকে জানায়। পুতিন তখন শিডিউল ডিলে করে মোদীকে নিজের বুলেটপ্রুফ গাড়িতে করে প্রায় ৪৫ মিনিট পর নিয়ে গেলেন দ্বিপাক্ষিক মিটিং-এ। যাতে যে কোনো হামলা ব্যর্থ হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, মোদীকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল চীনে, আর ঢাকায় মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের একজন সিনিয়র অফিসার মরলেন কীভাবে? গোয়েন্দা মহল বলছে – র’ আর রাশিয়ান এফএসবি-র একটা জয়েন্ট অপারেশন চালানো হয়েছে ঢাকায়। টেরেন্স জ্যাকসনকে “নিউট্রালাইজড” করা হয়েছে। মানে সোজা বাংলায়, তাকে খতম করে দেওয়া হয়েছে।
এই থিয়োরিতে আরো জোর পেলো প্রধানমন্ত্রী মোদীর একটা বক্তব্য। চীন থেকে ফিরে সেমিকন ইন্ডিয়া ২০২৫ সম্মেলনে তিনি বললেন, “আমি গিয়েছিলাম বলে তালি বাজাচ্ছেন, না ফিরে এসেছি বলে?” কথাটা অদ্ভুত শোনালেও, যারা ঘটনার ভেতরের খবর রাখেন, তারা বুঝে গেলেন এর মানে কী। বেঁচে ফিরে আসাটাই বড় ব্যাপার ছিল।
এখন অনেকেই বলবেন, এগুলো তো থিয়োরি। প্রমাণ কোথায়? ঠিক আছে, প্রমাণ নিয়ে আসি। পুতিন কেন শিডিউল বদলে মোদীর জন্য অপেক্ষা করলেন? কেন নিজের গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন? এগুলো সাধারণ ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রোটোকল খুবই কড়া। কিন্তু পুতিন সেসব ভেঙে মোদীকে নিজের সুরক্ষায় নিয়েছিলেন। কেন? কারণ তিনি জানতেন কী বিপদ আসতে পারে।
আর টেরেন্স জ্যাকসন? একজন স্পেশাল ফোর্সের কমান্ড ইন্সপেক্টর জেনারেল ছয় মাস ধরে ঢাকায় “ব্যবসা” করতে আসবেন? কোন ব্যবসা? গার্মেন্টস? চামড়া? নাকি ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ?
মার্কিন স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ড (এয়ারবর্ন)- এই ইউনিটের ২৫ বছরব্যাপী একটা প্রজেক্ট ছিল বাংলাদেশে রেজিম চেঞ্জ। শেখ হাসিনার সরকার পতন আর আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য গৃহযুদ্ধ বাধানোর পরিকল্পনা। জুলাইয়ে যা ঘটেছে, সেটা কি সত্যিই স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন ছিল? না কি একটা সুপরিকল্পিত ক্যু?
হাজার হাজার তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমেছিল চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে। তাদের আন্দোলন ছিল ন্যায্য। কিন্তু সেই আন্দোলনকে হাইজ্যাক করা হলো। ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলো মাঠে নামলো। বিদেশী টাকা ঢুকলো। সেনাবাহিনীর একাংশ নীরব সমর্থন দিলো। ফলাফল? একটা নির্বাচিত সরকারের পতন। ক্ষমতায় এলেন ইউনূস। একজন সুদখোর মহাজন, যিনি গরিবদের নামে ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের মোড়কে মোড়া এক ব্যবসায়ী, যার আসল পরিচয় হলো পশ্চিমা শক্তির একজন বিশ্বস্ত লোক।
আর সেনাপ্রধান ওয়াকার? যিনি এখন নিজের নিরাপত্তা বাড়িয়েছেন। কেন বাড়াতে হলো? দেশতো তার হাতেই আছে। সেনাবাহিনীই তো এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তাহলে ভয় কিসের? ভয় আসলে এই যে, তিনি জানেন কী খেলায় নেমেছেন। তিনি জানেন ঢাকার হোটেলগুলোতে কী ঘটেছে। তিনি জানেন র’ আর এফএসবি যখন একসাথে কাজ করে, তখন কী হয়!
র’ কোনো সাধারণ গোয়েন্দা সংস্থা নয়। এটা সেই সংস্থা যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষের ন্যায্য স্বাধিকার আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে কসাই পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে বাংলাদেশের পাশে ছিলো। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে র’-এর ভূমিকা সবাই জানে। মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ, গেরিলা অপারেশন পরিচালনা – সব কিছুতে র’-এর সহযোগিতা ছিল। তারা শ্রীলংকায় তামিল টাইগারদের দমন করতে সাহায্য করেছে। আফগানিস্তানে তালেবানের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ – পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নেটওয়ার্ক এতটাই শক্তিশালী যে কোথায় কী হচ্ছে সব তাদের নখদর্পণে।
আর রাশিয়ার এফএসবি? সোভিয়েত আমলের কেজিবি-র উত্তরসূরি। চেচনিয়ার বিদ্রোহ দমন, ইউক্রেনে অপারেশন, সিরিয়ায় যুদ্ধ- সব জায়গায় তাদের সফলতার রেকর্ড আছে। পুতিন নিজে এফএসবি-র প্রধান ছিলেন। তিনি জানেন কীভাবে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক চালাতে হয়। এই দুই সংস্থা যখন একসাথে কাজ করে, তখন পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের থামাতে পারে না।
ঢাকায় যা ঘটেছে, সেটা একটা বার্তা দিচ্ছে। বার্তা ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে, বার্তা ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে, আর বার্তা ঢাকার নতুন অবৈধ শাসকদের উদ্দেশ্যে। বার্তাটা হলো – বাংলাদেশের মাটিতে ভারত বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে পরিণতি কী হবে। টেরেন্স জ্যাকসন আর পাকিস্তানি আইএসআই এজেন্ট সেই পরিণতি দেখে মরার আগে নিজ চোখে দেখে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ইউনূস আর ওয়াকার কি এই বার্তা বুঝতে পারছেন? তারা হয়তো ভাবছেন আমেরিকা আর পাকিস্তান তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমেরিকা নিজেই এখন ভয়ে আছে। তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত স্পেশাল ফোর্সের একজন সিনিয়র কমান্ডারকে কীভাবে চুপচাপ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা দেখে তারা বুঝে গেছে র’ আর এফএসবি-র ক্ষমতা কতটা। পাকিস্তান? তারা তো নিজেরাই দুর্বল। তাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। তারা নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত, বাংলাদেশে তাদের দালালদের বাঁচাবে কীভাবে?
ইউনূস যদি মনে করেন তার নোবেল পুরস্কার তাকে বাঁচাবে, তাহলে তিনি ভুল করছেন। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে নোবেল পুরস্কারের কোনো মূল্য নেই। আর ওয়াকার যদি মনে করেন সেনাবাহিনী তার সাথে আছে, তাহলে তিনিও ভুল করছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা দেশপ্রেমিক, যারা বুঝতে পারছেন দেশকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকরাই বিদ্রোহ করে মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিল। ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
আমেরিকা আর পাকিস্তান যে খেলা খেলছে, তাতে ইউনূস-ওয়াকার শুধুই পণ। এই দুই দেশের কোনো বিশ্বস্ততা নেই। আফগানিস্তানে তারা কীভাবে তালেবানকে ব্যবহার করে শেষে ফেলে দিয়েছে, সবাই দেখেছে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে তারাই ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তারাই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পরিণতি কী হয়েছিল? এসব কি ইউনূস-ওয়াকার ভুলে গেছেন?
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পরিণাম কী হবে, তা এই দুই দালাল বোঝে না। তারা ভাবছে বিদেশী মদদে ক্ষমতায় টিকে থাকবে। কিন্তু ভারত আর রাশিয়া কখনো চাইবে না যে তাদের পাশের দেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হোক। ইউক্রেনে রাশিয়া ১০ বছর অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত ১০ বছর দূরে থাক ৫ বছরই অপেক্ষা করবে না। বাংলাদেশ ভারতের সরাসরি পাশে। এখানে অস্থিরতা মানে ভারতের পূর্ব সীমান্তে সরাসরি হুমকি। আর সেই হুমকি তারা কখনো মেনে নেবে না।
মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকায় ঢুকেছিল, তখন পাকিস্তানের পুরো সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য যুদ্ধবন্দী হয়েছিল। এখন পাকিস্তান আরো দুর্বল, ভারত আরো শক্তিশালী। তার সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার মতো পরাশক্তি। এই অবস্থায় ইউনূস-ওয়াকার যদি মনে করেন তারা নিরাপদ, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
টেরেন্স জ্যাকসনেরও নিরাপত্তা ছিল। পাকিস্তানি আইএসআই এজেন্টেরও নিরাপত্তা ছিল। তারপরও তারা এখন লাশ। র’ আর এফএসবি যখন টার্গেট ঠিক করে, তখন সেই টার্গেট এড়ানোর কোনো উপায় নেই। কত নিরাপত্তা বাড়ানো হবে? কত গার্ড দেওয়া হবে? যখন শত্রু ভেতরেই থাকে, তখন বাইরের নিরাপত্তা কোনো কাজে আসে না।
ইউনূস-ওয়াকারের মনে রাখা উচিত, তারা ঢাকায় বসে আছেন। ঢাকা একটা শহর যেখানে গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়ানো অসম্ভব। ওয়েস্টিন হোটেল আর শেরাটন হোটেলে যা ঘটেছে, তা ঘটেছে তাদের সরকারের নাকের ডগায়। তাদের পুলিশ, তাদের নিরাপত্তা বাহিনী কিছুই করতে পারেনি। এটাই প্রমাণ করে যে র’ আর এফএসবি চাইলে ঢাকায় যেকোনো কিছু করতে পারে। যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায়।
এখন ইউনূস-ওয়াকারের সামনে দুটো রাস্তা। হয় তারা বুঝে নেবেন যে বাংলাদেশকে ভারত-রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না, আর সেই অনুযায়ী নীতি পরিবর্তন করবেন। নয়তো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে টেরেন্স জ্যাকসনের মতো পরিণতি। ঢাকার আরেকটা পাঁচতারা হোটেলে আরেকটা রুমে আরো দুটো লাশ পড়ে থাকতে পারে। সেই লাশগুলোও চুপচাপ চলে যাবে। কোনো ময়না হবে না, কোনো তদন্ত হবে না। শুধু দুটো খালি রুম থেকে যাবে, আর ইতিহাসের পাতায় আরো দুটো নাম যুক্ত হবে।
তথ্যসূত্র :
১) ঢাকায় রহস্যমৃত্যু মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের কর্তার, ৬ মাস ধরে কী করছিলেন সেখানে?
২) মোদীকে নিয়ে চীনা রাস্তায় ‘চলমান দুর্গে’ সফর পুতিনের
৩) তিন হেলিকপ্টারে ভারতীয় গোয়েন্দাদের গোপনে বাংলাদেশ সফর ও জেনারেল ওয়াকারের তৎপরতা
আরো পড়ুন

