Share
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার অনুমতি পাওয়ার পর বিএনপি এখন অপেক্ষায় আছে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য। দলীয় নেতৃত্ব জানাচ্ছে, এগুলো প্রয়োজন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এই আপাত সরল ব্যাখ্যার বাইরে যে প্রশ্নগুলো উঠছে, সেগুলো অনেক জটিল এবং সম্ভাব্য বিপজ্জনক।
প্রথম প্রশ্ন হলো, এই মুহূর্তে এত বড় মাপের সামরিক মানের সরঞ্জাম সংগ্রহের তাগিদটা আসলে কী? বিএনপি বলছে নির্বাচনী প্রচারের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু যে দেশে বর্তমানে কোনো নির্বাচনের সময়সূচিই ঘোষিত হয়নি, সেখানে জুনে একটি গাড়ি এবং অক্টোবরে একটি বাসের জন্য অনুমতি নেওয়ার এই তাড়াহুড়োটা ঠিক কতটা যৌক্তিক? আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শটগান ও পিস্তলের আবেদন। এই সম্মিলিত উদ্যোগ দেখে মনে হতেই পারে, এখানে শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার চেয়ে অন্য কিছু পরিকল্পনা হচ্ছে।
বিশেষ করে তারেক রহমানের অতীত ইতিহাস মাথায় রাখলে এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। দুই হাজারের দশকে তার বিরুদ্ধে যে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা হয়েছিল, সেটা শুধু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। তখন তার চারপাশে গড়ে উঠেছিল হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক একটা সমান্তরাল ক্ষমতা কাঠামো, যেখানে নিয়মিত পুলিশ-প্রশাসনের বাইরে একটা আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ছিল। সেই সময়ের ঢাকা শহরে কে জানে না যে রাজধানীতে কোথায় কোন ব্যবসা চলবে, কোন এলাকায় কে থাকবে, এমনকি কোন মামলার রায় কেমন হবে এসবেও হাওয়া ভবনের হাত ছিল? তখন যে প্রাইভেট সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছিল, তার ভয়াবহতার গল্প এখনও মানুষের মুখে মুখে।
এরপর ২০০৮ সালে “আর কখনো রাজনীতি করবো না” মুচলেকা দিয়ে লন্ডনে পালিয়ে পর থেকে তারেক রহমান কীভাবে নিজের জীবন সাজিয়েছেন, সেটাও একটা বিস্ময়। লন্ডন একটা ব্যয়বহুল শহর, আর সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য চাই বিপুল অর্থ। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আর্থিক দুর্নীতির যেসব মামলা আছে, সেগুলো দেখলে বোঝা যায় এই অর্থের উৎস কোথায়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, লন্ডনে বসে যদি কেউ নামে-বেনামে ব্যবসা চালায়, আর সেই ব্যবসার পুঁজি আসে সন্দেহজনক উৎস থেকে, তাহলে সেই অর্থ দিয়ে কি শুধু ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহ হয়? নাকি সেখান থেকে আরও বড় কোনো পরিকল্পনায় বিনিয়োগ হতে পারে?
লন্ডন শুধু একটা বসবাসের জায়গা নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং হাব। যেখানে সামরিক সরঞ্জাম থেকে শুরু করে প্রাইভেট সিকিউরিটি কনসালটেন্সি – সবকিছুর বাজার আছে। এখানে ব্ল্যাকওয়াটার বা অ্যাকাডেমির মতো প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানির অফিস আছে, কনট্রাক্টর আছে, আর আছে সেই সব মধ্যস্থতাকারী যারা অর্থের বিনিময়ে যেকোনো ধরনের ‘সেবা’ সরবরাহ করতে পারে। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যদি এই পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকে এবং তার হাতে যথেষ্ট অর্থ থাকে, তাহলে তার পক্ষে এমন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়।
এখন বিএনপি যে বুলেটপ্রুফ গাড়ি এবং অস্ত্রের লাইসেন্স নিচ্ছে, তা দিয়ে শুরু হতে পারে একটা ছোট পরিসরের প্রাইভেট সিকিউরিটি ইউনিট। আপাতদৃষ্টিতে এটা শুধুই চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স বা সিএসএফের সম্প্রসারণ। কিন্তু একবার যদি এই কাঠামো দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে এটাকে যেকোনো সময় যেকোনো কাজে লাগানো যায়। বুলেটপ্রুফ গাড়ি মানে শুধু একটা গাড়ি নয়, এটা একটা মোবাইল কমান্ড সেন্টার হতে পারে। আর অস্ত্র মানে শুধু আত্মরক্ষা নয়, সেটা হতে পারে একটা ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম।
বারভিডার তথ্য অনুযায়ী, একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি আমদানি করতে খরচ পড়ে প্রায় ২২ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি, চালক এবং নিরাপত্তা কর্মীদের বেতন। একটা বাসের জন্য খরচ আরও বেশি হবে। তার মানে বিএনপির হাতে এখন এমন পরিমাণ তরল অর্থ আছে যা দিয়ে তারা এই ধরনের ব্যয়বহুল প্রকল্পে যেতে পারছে। এই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। বিশেষ করে যখন তাদের মূল নেতা দেশের বাইরে থাকেন এবং দেশে দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত, তখন এই বিপুল ব্যয়ের ক্ষমতা আসছে কোথা থেকে?
পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এবং তাদের নিয়োগ করা এজেন্টদের হাতে আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু এই একই যুক্তি তো অন্য দলের নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাহলে কেন শুধু বিএনপিকেই এই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে? আর যদি সত্যিই এই ধরনের হুমকি থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী কি যথেষ্ট নয়? কেন দরকার পড়ছে প্রাইভেট অস্ত্র ও সাঁজোয়া যানবাহনের?
এখানে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। বর্তমান সরকার যেভাবে ক্ষমতায় এসেছে, তাতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। তাহলে বিএনপি এখন যে সামরিক-স্তরের সরঞ্জাম সংগ্রহ করছে, তা কি সেই সহযোগিতারই অংশ? নাকি এটা একটা আলাদা খেলা, যেখানে বিএনপি নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করতে চাইছে? যদি দ্বিতীয় ক্ষেত্রটা সত্যি হয়, তাহলে এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ একটা রাজনৈতিক দলের হাতে যখন নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী থাকে, তখন সেটা রাষ্ট্রের একচেটিয়া সহিংসতার অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে।
ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে রাজনৈতিক দল প্রথমে নিজেদের নিরাপত্তার নামে সশস্ত্র ইউনিট তৈরি করেছে, পরে সেটা রূপান্তরিত হয়েছে প্রাইভেট মিলিশিয়ায়। লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা – সর্বত্রই এমন ঘটনা ঘটেছে। আর একবার যখন এই ধরনের বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেটা ব্যবহার হয় বিরোধীদের দমন করতে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে, এমনকি নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করতেও।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক সহিংসতার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যে অস্থিরতা দেখা গেছে, তাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে যদি এখন আরও একটা অস্ত্রধারী গোষ্ঠী যুক্ত হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। আর বিএনপির নেতৃত্ব যেভাবে বারবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, তাতে মনে হতে পারে তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যেখানে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ অবধারিত হয়ে উঠবে।
প্রাইভেট মিলিটারি কন্ট্রাক্টর বা পিএমসি ব্যবসায় এখন বিশ্বজুড়ে বিপুল অর্থ ঘোরে। শুধু নিরাপত্তা সেবা নয়, এরা প্রশিক্ষণ দেয়, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে, এমনকি সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নেয়। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এমনকি ইউরোপেও এদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। তারেক রহমান যদি লন্ডনে এই ধরনের কোনো নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি। কারণ এই ধরনের কোম্পানিগুলো শুধু অর্থের জন্য কাজ করে, তাদের কোনো আদর্শিক বা নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই।
বিএনপির বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তারা একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। প্রথমে অস্ত্র ও গাড়ির অনুমতি, এরপর হয়তো আসবে আরও বেশি সংখ্যক কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, এবং শেষ পর্যন্ত একটা পূর্ণাঙ্গ আধা-সামরিক বাহিনীর রূপরেখা। এটা শুধু অনুমান নয়, বরং তাদের অতীত ইতিহাস এবং বর্তমান কার্যক্রম মিলিয়ে দেখলে এই সম্ভাবনা অস্বীকার করা কঠিন।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এই সব কার্যক্রম চলছে এমন এক সময়ে যখন দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। নির্বাচন কমিশন, আদালত, প্রশাসন – ইউনুস আর জামাতের পোষা এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই পরিস্থিতিতে যদি কোনো রাজনৈতিক দল নিজস্ব সশস্ত্র শক্তি গড়ে তোলে, তাহলে তাকে জবাবদিহি করার মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা থাকে না। আর এটাই হয়তো বিএনপির হিসাবের অংশ।
অস্ত্র আর গাড়ি শুধু নিরাপত্তার জন্য নয়, এগুলো ক্ষমতার প্রতীকও। রাস্তায় যখন একটা বুলেটপ্রুফ বাস যাবে, তার পেছনে সশস্ত্র গার্ড থাকবে, তখন সেটা জনগনকে যে বার্তাটা দেবে সেটা হলো : আমাদের ক্ষমতা আছে, আমরা সুরক্ষিত, আর আমাদেরকে তোমাদের ভয় পাওয়া উচিত। এই ধরনের প্রদর্শন রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা শুধু নিজেদের সমর্থকদের উৎসাহিত করে না, বরং প্রতিপক্ষকেও ভীতসন্ত্রস্ত করে।
বিএনপির এই পদক্ষেপ নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো, এটা যদি সফল হয়, তাহলে অন্য দলগুলোও একই পথ অনুসরণ করবে। তখন দেশে শুধু রাষ্ট্রীয় বাহিনীই থাকবে না, থাকবে একাধিক প্রাইভেট মিলিশিয়া। আর এই মিলিশিয়াগুলোর মধ্যে যদি সংঘর্ষ শুরু হয়, তাহলে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা কোনো কাল্পনিক দুঃস্বপ্ন নয়, বরং পৃথিবীর অনেক দেশে এমন পরিস্থিতি বাস্তবে ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন এই অনুমতি দিলো? পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদন যদি সত্যিই এই হুমকির কথা বলে, তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কি শুধু অনুমতি দিয়ে দায় সারা? নাকি রাষ্ট্রেরই উচিত এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা? কিন্তু যদি অনুমতি দেওয়া হয়েছে অন্য কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায়, তাহলে সেটা আরও ভয়ংকর। কারণ তার মানে হলো, রাষ্ট্র নিজেই সহায়তা করছে এমন একটা শক্তির উত্থানে, যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্যই হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বুলেটপ্রুফ গাড়ি এবং অস্ত্র দিয়ে শুরু হতে পারে একটা নতুন অধ্যায়, যেখানে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও সহিংস এবং অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠবে। আর এই পরিস্থিতি থেকে লাভবান হবে কারা? অবশ্যই তারা নয়, যারা গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। বরং লাভবান হবে তারা, যারা অস্থিরতার মধ্যেই নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায়।
আরো পড়ুন

