Share
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার খবরটা যখন ছড়িয়ে পড়ল, তখন অনেকেই ভেবেছিল হয়তো আরেকটা সাধারণ দুর্ঘটনা। কিন্তু পরের দিন সকালে যখন ক্ষতির পরিমাণ বেরিয়ে এলো ১২ হাজার কোটি টাকা, তখন বোঝা গেল এটা শুধু আগুন নয়, পুরো রফতানি খাতের মেরুদণ্ডে আঘাত। আর সবচেয়ে বেদনার বিষয় হলো, এই আগুন একা আসেনি। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটা বড় অগ্নিকাণ্ড। মিরপুরে ১৬ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গেছে, চট্টগ্রামে কারখানা পুড়ে ২৫ কোটি টাকার ক্ষতি, আর এখন বিমানবন্দর। এই পরপর ঘটনাগুলো দেখে যেকোনো মানুষের মনেই প্রশ্ন আসবে এত বড় বড় দুর্ঘটনা কি আসলেই দুর্ঘটনা, নাকি অন্য কিছু?
এই প্রশ্নটা কিন্তু শুধু আবেগ থেকে আসছে না। বাস্তব কিছু তথ্যই বলছে যে দেশের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ আর নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কাছ থেকে আমরা ন্যূনতম সেবাটুকুও পাচ্ছি না। একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে – যেখানে কোটি কোটি টাকার পণ্য মজুদ থাকে, সেখানে কোনো অটো ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম নেই। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? এটা কি গ্রহণযোগ্য? আর যদি এটাই বাস্তবতা হয়, তাহলে এর দায় কার?
ইউনুস সাহেবের নেতৃত্বাধীন যে অ-সরকার এখন চলছে, তারা ক্ষমতায় এসেছে এক অস্বাভাবিক পথে। জুলাইয়ে যে দাঙ্গা হলো, যার মধ্য দিয়ে একটা নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দেওয়া হলো, সেই ঘটনাটার পুরো প্রেক্ষাপট এখনও অস্পষ্ট। কোন শক্তি কাজ করেছিল, কোন অর্থায়ন ছিল, কোন সংগঠনের সহায়তা ছিল – এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকেই চুপ করিয়ে দেন। কিন্তু এখন যখন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন কি আর চুপ থাকা যায়?
যে মানুষটাকে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য সম্মান করা হয়, তিনি কিনা এখন দেশ চালাচ্ছেন কোনো ম্যান্ডেট ছাড়া। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের ব্যবসা নিয়ে তার সমালোচনা নতুন নয়। দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা নিয়ে তাদের আরও দরিদ্র করার অভিযোগ বহু পুরনো। আর এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের পুরো অর্থনীতিই যেন একই পথে হাঁটছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এখন ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম – মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ব্যাংকে সুদহার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। কোন ব্যবসায়ী এই সুদে টাকা নিয়ে লাভ করবে? কোন উদ্যোক্তা নতুন শিল্প গড়বে?
বিমানবন্দরের আগুন নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস এসে গিয়েছিল। তাহলে কেন ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা হলো? ৩০ সেকেন্ডে যদি সাড়া দেওয়া হয়, তাহলে কেন ৩৭টা ফায়ার ইউনিট এসেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লাগল? কেন গুদামে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার দায় কার? সিভিল এভিয়েশন অথরিটির? কাস্টমসের? নাকি যারা দেশ চালাচ্ছেন, তাদের?
তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই তদন্তে আসলে কী বেরোবে? যে সরকারের নিজেরই বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তারা কি সত্যিকারের তদন্ত করতে পারবে? নাকি এটাও হবে আরেকটা চোখ ধাঁধানোর ব্যবস্থা?
ব্যবসায়ীদের কথা শুনলে হৃদয় ভেঙে যায়। মতিঝিলের একজন ছোট আমদানিকারক বলছেন, তার ৪০ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। তার সারা বছরের আয় ছিল ওই শীত মৌসুমের ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। এখন তিনি দেউলিয়া। তার মতো কত মানুষ আছে? কত পরিবার শেষ হয়ে গেল? গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রিসমাসের অর্ডার মিস হলে ক্রেতারা আর ফিরে আসবে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো বলছে, ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে গেছে, তিন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওষুধ তৈরি হবে না। আর এসবের মধ্যে দিয়ে কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? সাধারণ মানুষ। যাদের চাকরি যাবে, যাদের ওষুধ পাওয়া যাবে না, যাদের জীবনযাত্রার খরচ আরও বাড়বে।
আর এই সবকিছুর মধ্যে একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায় – এত দ্রুত, এত পরপর এত বড় বড় দুর্ঘটনা কেন হচ্ছে? কারও কি লাভ হচ্ছে এতে? দেশের অর্থনীতি দুর্বল হলে, রফতানি কমে গেলে, ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হলে কার স্বার্থ পূরণ হয়? যে শক্তি এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তারা কি চায় যে বাংলাদেশ দাঁড়াতে না পারুক?
দেশের মানুষ এখন শুধু উত্তর চায়। চায় জবাবদিহিতা। চায় নিরাপত্তা। ইউনুস সাহেবের অ-সরকার যদি সত্যিই দেশের মঙ্গল চায়, তাহলে তাদের প্রমাণ করতে হবে কাজে, কথায় নয়। অবকাঠামো সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কারা আছে, তা বের করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সুদের হার কমাতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। নাহলে শুধু বক্তৃতা আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ হবে না।
বাস্তবতা হলো, এই মুহূর্তে দেশের ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে আছেন। শ্রমিকরা ভীত। সাধারণ মানুষ অনিশ্চয়তায়। আর যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো শক্ত পদক্ষেপ দেখছি না। যে দেশে একসময় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে আসত, সেই দেশে এখন অনির্বাচিত মানুষেরা চালাচ্ছেন সবকিছু। আর তার ফলাফল? পোড়া কারখানা, পোড়া গুদাম, পোড়া স্বপ্ন।
এখন দেখার বিষয়, তদন্তে কী বেরোয়। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এসব তদন্তের ফাইল ধুলোর তলায় চাপা পড়ে যায়। আর ততদিনে নতুন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, নতুন কোনো সংকট আসে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ কোথায় যাবে, সেটা ভাবতেও ভয় হয়।
আরো পড়ুন

