নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র, বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার এবং কৌশলগত ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় নব্বই শতাংশ এই বন্দর দিয়েই সম্পন্ন হয়। সেই বন্দরই আজ বিতর্কের কেন্দ্রে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন ডিসেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়ার চর ও ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
গোপন চুক্তির আড়ালে ম্যান্ডেটহীন সিদ্ধান্ত
চট্টগ্রাম বন্দর কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম অবকাঠামোর অংশ। এমন একটি স্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ হতে পারে না এটি নীতিগত ও সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত। অথচ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সংসদীয় আলোচনার বাইরে, গণশুনানি বা জনমত যাচাই ছাড়াই।
বর্তমান সরকারকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা-সংক্রান্ত প্রশ্ন স্পষ্ট। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদনহীন একটি প্রশাসনের এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার সাংবিধানিক অধিকার নেই। রাষ্ট্রের সম্পদ জনগণের মালিকানাধীন একটি ম্যান্ডেটবিহীন সরকার সে সম্পদের ওপর স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিলে তা আইনি ও নৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জযোগ্য।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় চুক্তির শর্ত, মেয়াদ, আর্থিক কাঠামো বা বিদেশি অপারেটর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এখনো অজ্ঞাত। এই গোপনীয়তা প্রমাণ করে, সিদ্ধান্তটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতার নয়; বরং পর্দার আড়ালে কোনো বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর সুবিধা নিশ্চিত করার ইঙ্গিত দেয়।
জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত ঝুঁকি
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাণিজ্যের কেন্দ্র নয় এটি জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ। ইতিহাস সাক্ষী, এই বন্দর দিয়েই অতীতে অবৈধ অস্ত্রচালান প্রবেশ করেছিল। ফলে বিদেশি অপারেটরের হাতে বন্দরের কার্যক্রম তুলে দেওয়া মানে নিরাপত্তা তদারকিতে নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করা।
যে কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছে বন্দরের নৌপথ, পণ্য চলাচল ও নিরাপত্তা তথ্য উন্মুক্ত হওয়া মানে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ হারানো। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। সেখানে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মানে বাংলাদেশের ওপর আঞ্চলিক নজরদারি ও প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া।
জনগণের সম্পদ, সরকারের নয়
চট্টগ্রাম বন্দর কোনো সরকারের সম্পত্তি নয় এটি জনগণের। সরকার কেবল জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে। অথচ জনগণের মতামত ছাড়াই, গণআলোচনার অনুপস্থিতিতে, বন্দর ইজারার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক আধুনিকায়নের প্রয়োজন অনস্বীকার্য, কিন্তু তার প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং দেশীয় সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। বিদেশি প্রভাব বা রাজনৈতিক স্বার্থে গৃহীত চুক্তি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক আর্থিক ও আইনি দায় তৈরি করতে পারে।
বন্দর ইজারার চুক্তিপত্র, আর্থিক শর্তাবলি, মেয়াদ, অপারেটর নির্বাচন প্রক্রিয়া—সবকিছু জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। একইসঙ্গে, সংসদীয় তদারকির আওতায় একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এ সিদ্ধান্তের বৈধতা, অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ও নিরাপত্তা প্রভাব যাচাই করা জরুরি।
এটি শুধু প্রশাসনিক প্রয়োজন নয় এটি গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতারও প্রতিফলন। একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিরাপদ নয় এই আশঙ্কা আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ইজারা কেবল অর্থনৈতিক চুক্তি নয়; এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে এক গভীর পরীক্ষা।
জনগণের অজান্তে, বিদেশি স্বার্থে বা রাজনৈতিক সুবিধায় নেওয়া সিদ্ধান্ত ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না। রাষ্ট্রের সম্পদে জনগণের অধিকার অখণ্ড সে অধিকার রক্ষাই এখন সময়ের দাবি। চট্টগ্রাম বন্দরের ইজারা তাই আজ কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয় এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সার্বভৌমত্বের প্রতিচ্ছবি।