চৌদ্দ মাসে চৌদ্দ বার বিদেশ সফর। হিসাবটা মিলিয়ে দেখলে মাসে গড়ে একবার। কখনো একটু বেশি, কখনো একটু কম। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যেন দেশ চালানোর চেয়ে বিমানবন্দরে বেশি সময় কাটাচ্ছেন। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ অধিবেশন থেকে ফিরে এসে এক মাসও পার হতে না হতেই আবার ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হয়ে গেলেন রোমের উদ্দেশ্যে।
এবারের সফরটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে একটু বেশিই। কারণটা শুধু সংখ্যা নয়, উদ্দেশ্যও। ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম নামের একটি অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দিতে গিয়েছেন তিনি। শুনতে ভালো লাগলেও খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, এই ফোরাম ২০২১ সাল থেকে শুরু হয়েছে।
আগের চার বছরে এতে মূলত কৃষিমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন। এবারও অন্যান্য দেশ থেকে কৃষিমন্ত্রীরা এসেছেন। বাংলাদেশের কৃষি উপদেষ্টাও পরের দিন একটি সেশনে যোগ দেবেন। তাহলে প্রধান উপদেষ্টা নিজে কেন গেলেন?
এটা কোনো দ্বিপাক্ষিক সফর নয়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলানির সঙ্গে বৈঠকের কথা প্রথমে বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সেরকম কিছু হয়েছে কিনা তার স্পষ্ট তথ্য নেই। একটি বহুপাক্ষিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে আসা। এটুকুই। এর জন্য কি একজন দেশপ্রধানের সেখানে যাওয়া জরুরি ছিল? জনগণের করের টাকায় বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে এই সফর কি আসলেই রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য ছিল?
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদের প্রশ্নটা যৌক্তিক। একটি দেশের শীর্ষ নেতার এ ধরনের অনুষ্ঠানে যাওয়াটা কি সত্যিই জরুরি? বিশেষত যখন দেশে অসংখ্য জরুরি সমস্যা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভঙ্গুর, অর্থনীতি টালমাটাল। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা একের পর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত হচ্ছেন।
গত ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই উপদেষ্টা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে ১৩ দফা নির্দেশনা জারি করেছিল। সেখানে বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করা, একই অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা ও সচিব উভয়ের সফর এড়ানো, ছোট প্রতিনিধি দল পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই নির্দেশনা কাগজেই থেকে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিনিধি দলের আকার কমার বদলে বরং বেড়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের প্রশ্নটা মনে রাখার মতো। এত বড় প্রতিনিধি দলের প্রতিটি সদস্যের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কী? তারা কীভাবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করছেন? নাকি এগুলো কেবল সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ মাত্র?
অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব কী? একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র পরিচালনায় স্থিতিশীলতা আনা। জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দেশের ভেতরে নেতৃত্বের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠছে। প্রধান উপদেষ্টা যখন বিদেশে একটির পর একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দিচ্ছেন, ততক্ষণে দেশের সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদের মন্তব্যটা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা এখন জাতীয় নেতা। বক্তৃতা দেওয়ার চেয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেওয়াটাই তার প্রধান কাজ হওয়া উচিত। সেই কাজে বারবার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মানুষ যখন প্রশ্ন তোলে, সরকারের উচিত সেসব প্রশ্নকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। কিন্তু মনে হচ্ছে এই সমালোচনাগুলোকে আমলেই নেওয়া হচ্ছে না। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জবাবদিহিতা আরও বেশি জরুরি, কারণ তারা নির্বাচিত নন। তাদের বৈধতা আসে জনগণের আস্থা থেকে। আর সেই আস্থা তৈরি হয় কাজের মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে নয়। বিদেশে গিয়ে বক্তৃতা দিলে হয়তো আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিতি দেখানো যায়, কিন্তু দেশের ভেতরে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা পূরণ হয় না।
রোম সফরের খরচ কত হয়েছে, তার হিসাব জনগণ জানতে চাচ্ছে। কতজন গিয়েছেন, কী কী অর্জন হয়েছে, বাংলাদেশ কী সুবিধা পেয়েছে, এসবের স্বচ্ছ তথ্য দেওয়া জরুরি। না হলে এই সফরগুলো শুধু বিলাসিতা আর অপচয় বলেই মনে হবে। একটি দরিদ্র দেশের মানুষের করের টাকা খরচ করে এভাবে বারবার বিদেশ যাওয়ার নৈতিক অধিকার কারও নেই, প্রধান উপদেষ্টা হলেও না।