Wednesday, October 22, 2025

২৭৫ মেগাওয়াট অন্ধকার: এনজিও অভিজ্ঞতায় দেশ চালানোর ফলাফল

Share

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন থেমে গেছে গভর্নর ভাল্ভ আর টারবাইনের সেন্সর নষ্ট হওয়ায়। মেরামত করতে লাগবে অন্তত এক সপ্তাহ। খবরটা শুনতে সাধারণ মনে হলেও, এর পেছনের গল্পটা বলে দেয় একটা দেশ কীভাবে অদক্ষ হাতে পড়ে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে।

মাত্র কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছিল। সেই দেশেই এখন প্রতিদিন লোডশেডিং যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরমে মানুষ হাঁসফাঁস করছে, কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছেন। আর এর মাঝে বড়পুকুরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটা ইউনিট বন্ধ হয়ে গেলে সেটা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো ব্যাপার।

প্রশ্ন হলো, এমন হলো কেন? একটা দেশ যেখানে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ খাতে স্বনির্ভরতার দিকে এগোচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ করে এই পিছিয়ে যাওয়া কেন? উত্তর খুঁজতে গেলে চোখ চলে যায় গত এক বছরের শাসনব্যবস্থার দিকে। যে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশের হাল ধরা হয়েছে, তার ফলাফল এখন দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন ভোগ করছে।

ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়াটাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। জুলাই মাসে সারাদেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার পেছনে কাদের মদদ ছিল সেটা এখন আর কারও অজানা নয়। বিদেশি শক্তির অর্থায়ন, জঙ্গি মতাদর্শের প্রভাব, আর সামরিক সমর্থন নিয়ে যে ক্যু হয়েছে, তার ফলে ক্ষমতায় এসেছে এমন কিছু মানুষ যাদের দেশ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মাইক্রোফাইন্যান্স নিয়ে কাজ করা আর একটা দেশ চালানো কি এক জিনিস?

ইউনুস সাহেব গরিব মানুষদের ঋণের নামে রক্ত চুষে বিদেশে ভালোই খ্যাতি অর্জন করেছেন, কিন্তু একটা দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে প্রয়োজন হয় প্রশাসনিক দক্ষতা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, আর সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। এনজিও চালানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায় না। একটা কোম্পানির সিইও হওয়া আর একটা দেশের প্রধান হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল।

বড়পুকুরিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই ঘটনা আসলে একটা বড় সমস্যার ছোট্ট একটা লক্ষণ মাত্র। গত এক বছরে দেশের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে যে অবহেলা হয়েছে, তার প্রমাণ এখন একের পর এক সামনে আসছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে। জ্বালানি আমদানিতে বিলম্ব হচ্ছে। বিদেশি ঋণের শর্ত মেনে নিতে গিয়ে জনগণের ঘাড়ে চাপছে অতিরিক্ত বোঝা।

মজার ব্যাপার হলো, যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা দেশি সরকারকে সমালোচনা করত দুর্নীতি আর অদক্ষতার জন্য। কিন্তু নিজেরা ক্ষমতায় এসে দেখাচ্ছে যে, অদক্ষতার আসলে কোনো সীমা নেই। একটা দেশকে চালাতে হলে শুধু সমালোচনা করা জানলেই হয় না, বাস্তব সমাধানও দিতে হয়। নীতিকথা শোনানো সহজ, কিন্তা মাঠপর্যায়ে কাজ করে ফল দেখানো অনেক কঠিন।

বড়পুকুরিয়ার তৃতীয় ইউনিট বন্ধ হওয়ার পেছনে প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে ঠিকই, কিন্তু আসল সমস্যা হলো রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক। যখন একটা শাসনব্যবস্থা বিদেশি প্রভুদের খুশি করতে ব্যস্ত থাকে, যখন আন্তর্জাতিক মহাজনদের শর্ত মেনে নিতেই সময় চলে যায়, তখন দেশের ভেতরের সমস্যাগুলো অবহেলিত হতে বাধ্য। সুদের বোঝা মাথায় নিয়ে তো দেশ চালানো যায় না।

এই যে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে, এর ভুক্তভোগী কারা? ঢাকার এয়ার কন্ডিশনড অফিসে বসে থাকা কর্তাব্যক্তিরা নয়। ভুক্তভোগী হচ্ছে গ্রামের সেই কৃষক যিনি সেচের পাম্প চালাতে পারছেন না। ছোট ব্যবসায়ী যার দোকানের ফ্রিজে মাছ মাংস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ যেখানে জেনারেটর না থাকলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার যেখানে গরমে ঘুম হয় না রাতে।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, এই সমস্যার সমাধান দিতে পারার মতো মানুষও এই দেশে আছে। যোগ্য প্রকৌশলী আছে, পরিকল্পনাবিদ আছে, অভিজ্ঞ প্রশাসক আছে। কিন্তু তাদের কথা কে শুনবে? যারা ক্ষমতায় আছে তারা তো বিদেশি প্রভুদের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে ব্যস্ত।

বড়পুকুরিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যে শাসনব্যবস্থার ভাঙন এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সেটা কি ঠিক করা যাবে? যে অবৈধ পথে ক্ষমতায় এসেছে, সেই শাসনের বৈধতা নিয়েই তো প্রশ্ন থেকে যায়। আর বৈধতা ছাড়া জনগণের আস্থা পাওয়া যায় না। আস্থা ছাড়া দেশ চালানো যায় না।

এক বছরেরও কম সময়ে দেশের যে অবস্থা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শুধু ভালো কথা বলা আর নৈতিকতার বুলি আওড়ানো দিয়ে দেশ চলে না। প্রয়োজন হয় বাস্তববুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, আর সর্বোপরি জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার মানসিকতা। মাঝখান থেকে সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। তারাই এই অদক্ষ, অবৈধ শাসনের সবচেয়ে বড় শিকার।

Read more

Local News