Share
নিজস্ব প্রতিবেদক
একসময়ের সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ এখন আমেরিকার আহারে পরিণত হচ্ছে। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ শুষে নিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। একসময় যে দেশ অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হতো। আজ সেটি মবের দেশ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলেও, ধীরে ধীরে এটি সরকারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক রক্তাক্ত ও বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে আবির্ভূত হয়। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পেছনে জামায়াতে ইসলামী, ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং আমেরিকা একটি গোপন ষড়যন্ত্র ছিল বলে দাবি করা হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবির এই আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। ড. ইউনুসের নাম আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, যিনি আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধে জড়িত ছিলেন।
চীনের আধিপত্য কমানো বঙ্গোপসাগরের প্রাকৃতিক সম্পদ হাতানোর পরিকল্পনা আমেরিকার বহুদিনের। এটি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি একটি নীলনকশার অংশ, যার লক্ষ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের আধিপত্য বিস্তার।
এই মিশনকে সামনে রেখে ৫ আগস্টের পর আমেরিকান নাগরিক আলী রীয়াজ ও খলিলুর রহমানকে ইউনূসের সরকার ঢোকানো হয়। এরপর করিডর, বন্দর দখলের বিভিন্ন প্রস্তাব দেয় আমেরিকার।
বাংলাদেশের একটি অংশ দখলে তৎপর হয়ে উঠেছে আমেরিকা। এ লক্ষ্যে দেশটি ঘনঘন সেনাবহর, যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে। আর এসব পাঠানো হচ্ছে চট্টগ্রামে। তাদের নজর বঙ্গোপসাগর ও চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমার মূল্যবান খনিজ সম্পদ, যার মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, এবং সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ‘ক্লে’, এখন লুটপাটের হুমকির মুখে। গত ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নরওয়ের অত্যাধুনিক গবেষণা জাহাজ ‘আর ভি ড. ফ্রিডজোফ নানসেন’ বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মৎস্যসম্পদ ও ইকোসিস্টেম জরিপের নামে প্রবেশ করে।
তবে এই জরিপের আড়ালে অগভীর সমুদ্রের তলদেশে থাকা ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ লুটের মার্কিন পরিকল্পনা রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ ইউএসএস ফিৎসজেরাল্ড। এর আগে গত মাসে চট্টগ্রামে মার্কিন বিমানবাহিনীর মহড়া হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র “কোয়াড পোর্টস ফর ফিউচার” কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে একটি বন্দর ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। এর লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করা এবং চীনের প্রভাব কমানো। সম্প্রতি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে প্রাথমিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম ধাপে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর তারা বন্দর নির্মাণ বা উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারে। সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপের এক-তৃতীয়াংশ প্রায় ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিতে আগ্রহী। প্রথমে দ্বীপের একটি অংশ বিদেশিদের জন্য পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলেও, পরবর্তী সময়ে। সেটি সামরিক ঘাঁটিতে রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সরাসরি আপত্তি না তুললেও চীন ও ভারতের বিরোধিতার ঝুঁকি নিয়েই চিন্তিত
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারে চীন-সমর্থিত গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান নিতে সক্রিয় হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট, মানবিক করিডোর, এবং চট্টগ্রাম বন্দর—সব মিলে এই অঞ্চলটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদও উত্তোলন করতে চায় দেশটি।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একটি “খ্রিস্টান রাজ্য” গঠনের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও করা হচ্ছে, যা পূর্ব তিমুরের ঘটনার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগেও সতর্ক করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে এমন একটি রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র চলছে । তিনি সেন্টমার্টিনে মার্কিনিরা ঘাঁটি করতে চায় সেই কথাও জানিয়েছিলেন।
সহিংসতা ছড়াল, জাতিসংঘ চুপ
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে সহিংসতা ও অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি স্থাপনা ধ্বংস, কারাগারে হামলা, জঙ্গি মুক্তি এবং পুলিশের ওপর নৃশংস হামলা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার টুর্ক সরাসরি কোনো নিন্দা জানাননি বরং আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। পুলিশ হত্যা ও সহিংসতা উপেক্ষা করা হয়।
সেনাবাহিনীর প্রতি জাতিসংঘের হুমকি
সূত্র বলছে, সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে চাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে একটি খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও এরসঙ্গে উল্লেখযোগ্য অংশ আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করা। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে পারলেই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটবে। আর এতে করে দেশে মার্কিনি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন সহজ হবে।
গত বছর ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা ও অরাজকতা। সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, কারাগারে হামলা, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মুক্তি, এবং পুলিশের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এসব ঘটনার পরও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার টুর্ক কোনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাননি। বরং ২৫ জুলাই ২০২৪-এ প্রকাশিত বিবৃতিতে তিনি একতরফাভাবে সরকারের সমালোচনা করে আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর জোর দিলেও, পুলিশ সদস্যদের নির্মম হত্যা, যেমন—এএসআই মোক্তাদিরকে ঝুলিয়ে হত্যা এবং বনানীতে পরিদর্শক মাসুদ পারভেজকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন।
সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ছিল জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ নিয়ে হুমকি। মার্চ ২০২৫-এ বিবিসির হার্ড টক অনুষ্ঠানে ভলকার টুর্ক নিজেই জানান, আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হলে, তাদের শান্তিরক্ষা মিশনে আর থাকতে দেওয়া হবে না।
এই হুমকির পর সেনাবাহিনী কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলাফল— সহিংসতা আরও বাড়ে। বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনী জাতিসংঘের চাপের কারণে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকে, যা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে তোলে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘ যখন সেনাবাহিনীকে হুমকি দেয়, তখন সেটা কার্যত আইন শৃঙ্খলার ভাঙনকে উৎসাহ দেওয়ার সামিল।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দাবি করা হয়—জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১,৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের পক্ষগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি।
অন্যদিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের হিসাব মতে নিহত সংখ্যা যথাক্রমে ৮২০ এবং ৮৩৪। রিপোর্টে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংস হামলা, বাসাবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ও গণপিটুনির ঘটনাগুলো উপেক্ষা করা হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভলকার টুর্ক আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন, যেন তিনি মানবাধিকার কমিশনার নন, বরং রাজনৈতিক পক্ষের মুখপাত্র।
এদিকে জাতিসংঘ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস জাতিসংঘের ভূমিকার জন্য প্রকাশ্যে কৃতজ্ঞতা জানান। তার বক্তব্য— গত বছরের জুলাই-আগস্টের অন্ধকার সময়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পাশে ছিল।”
এই বক্তব্য অনেকের কাছে জাতিসংঘের সরাসরি হস্তক্ষেপের স্বীকারোক্তি বলে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, “জাতিসংঘ এবং ড. ইউনুসের বোঝাপড়া ছিল পূর্বনির্ধারিত। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে এমন একজনকে বসানো হয়েছে, যিনি পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন।”
প্রথমে “গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন” হিসেবে প্রচারিত হলেও এখন জুলাই আন্দোলন রাজনৈতিক প্রকৌশলের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
শেখ হাসিনা বারবার পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। ৫ আগস্টের পর সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও রাখাইন করিডোর নিয়ে বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতা সেই সন্দেহকে আরও জোরালো করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কার্যত আমেরিকার একটি পক্ষ হয়ে গেছে। এতে দেশের গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে চাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে একটি খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও এরসঙ্গে উল্লেখযোগ্য অংশ আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করা। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে পারলেই দেশে জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটবে। আর এতে করে দেশে মার্কিনি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন সহজ হবে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং দলের নেতাদের আটকায়। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এধরণের কর্মকাণ্ডে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয়নি।
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা, জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা, আমেরিকা ও জাতিসংঘের ষড়যন্ত্র এবং সরকারের পতনের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এটি এক ভয়াবহ অধ্যায় যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন এবং বহিরাগত ষড়যন্ত্রের ছায়া জটিলভাবে মিশে আছে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সার্বভৌমত্বের জন্য এটি গভীর সংকটের সূচনা করেছে।
আরো পড়ুন

